কেন বিক্রি হলো ইয়াহু?

142176_153

স্বাধীন কোম্পানি হিসেবে ইয়াহুর অস্তিত্ব আর থাকছে না। সম্প্রতি মার্কিন টেলিকম জায়ান্ট ভেরিজোন ৪.৮৩ বিলিয়ন ডলারে ইয়াহুকে কিনে নিয়েছে। একসময় ইয়াহু ছিল ইন্টারনেট যুগের অন্যতম পথিকৃৎ। প্রতিষ্ঠানটি একসময় ব্যবহারকারীদের কাছে অনেক জনপ্রিয় ছিল। তবে বর্তমান সময়ের বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ভেরিজনের কাছে বিক্রি হলো। যুক্তরাষ্ট্রের টেলিকম জায়ান্ট ভেরিজন কমিউনিকেশনস ইয়াহুকে কেনার সঙ্গে সঙ্গে
ইয়াহুর ইতিহাসের সমাপ্তি হলো আর ভেরিজন নতুন আরেকটি যুগের শুরু হলো। লিখেছেন আহমেদ ইফতেখার

ইন্টারনেট বিশ্বে এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ইয়াহু অধিগ্রহণ। সম্প্রতি ইয়াহু অধিগ্রহণ করছে ভেরাইজন। ভেরিজন মোবাইলের এই যুগে নিজেদের অবস্থানকে শক্তিশালী করতেই কিনেছে ইয়াহুকে। একটা সময় পর্যন্ত ইন্টারনেটের রাজ্যে রাজত্ব ছিল ইয়াহুর। ইয়াহুর সার্চ ইঞ্জিন বা ইয়াহুর ইমেইল সেবার জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। পরবর্তী সময়ে গুগলের কাছে বাজার হারায় ইয়াহু। বেশ কয়েকবারই ব্যবসায়িক কৌশল বদলে ইয়াহু বাজার ধরার চেষ্টা করলেও তাতে খুব বেশি সফল হতে পারেনি তারা। এর আগে ২০০৮ সালে মাইক্রোসফটের প থেকে ইয়াহুকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল ৪ হাজার ৪ শ’ কোটি মার্কিন ডলারের। তাতে নিজেদের বিক্রি করে দিতে তখন রাজি হয়নি ইয়াহু। একটা সময় তাদের সম্পদের মূল্যমান ১২ হাজার ৫ শ’ কোটি ডলারেও পৌঁছায়। কিন্তু সেই জায়গা থেকে কেবল পতন হতে থাকে ইয়াহুর। চার বছর আগে ইয়াহুর সিইওর দায়িত্ব গ্রহণ করেন গুগল থেকে আসা নারী কর্মকর্তা মারিসা মেয়ার। তিনিও ইয়াহুকে সম্ভাবনার জায়গায় পৌঁছে দিতে পারেননি। তবে মারিসা বলেছেন, ‘ইয়াহু এমন একটি কোম্পানি যেটি একসময় বিশ্বকে বদলে দিয়েছে। ভেরিজন ও এওএল-এর সঙ্গে সমন্বিত হয়ে ইয়াহু বিশ্বকে বদলে দেয়ার সেই ধারা অব্যাহত রাখবে।’
বিক্রির পেছনে কারণ
২০০৮ সালে ব্যবসায় শীর্ষে ওঠে ইয়াহু। কিন্তু ধীরে ধীরে তার পতন শুরু হয়। পরিকাঠামোগত পরিবর্তন ও অন্যান্য পরিবর্তন এনেও ফেসবুক ও গুগলের জনপ্রিয়তার সঙ্গে পেরে ওঠেনি প্রতিষ্ঠানটি। সার্চ ইঞ্জিন হোক কিংবা মেল-এর দিক থেকে অনেক এগিয়ে যায় গুগল। বেশ কিছু সিদ্ধান্ত ইয়াহুর পে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় টেক্কা দিতে গিয়ে তাম্বলার নামে এক সোশ্যাল ব্লগিং সার্ভিস কিনে ইয়াহু। কিন্তু ফেসবুকের জনপ্রিয়তার ধারেকাছে তো পৌঁছায়নি সেটিও, আদতে এ সাইটকে ফপ বললে অত্যুক্তি করা হয় না। এই লোকসানও কোম্পানির পে যথেষ্ট তিকর হয়।
সময়ের সঙ্গে গুগল ও ফেসবুক যেভাবে নিজেদের পরিবর্তন করেছে, সেইভাবে বিবর্তিত হতে পারেনি ইয়াহু। ফলে জনপ্রিয়তা হারিয়েছে ব্যবহারকারীদের মধ্যে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব থেকে বেশি বেতনের মহিলা সিইও মারিসা মায়ার কাজ করেন এই প্রতিষ্ঠানে। সবরকম প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি কাজ চালিয়ে গিয়েছেন। এখন যদিও প্রশ্ন উঠছে তার দতা নিয়ে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইয়াহু যেভাবে পিছিয়ে পড়েছিল, সেই ডুবন্ত তরীকে আর তুলে আনতে পারেননি তিনি। অবশেষে ভেরিজন ইয়াহুকে কিনে নেয় ৪৮৩ কোটি মার্কিন ডলারে।
ইতিহাস
১৯৯৪ সালে জেরি ইয়াং ও ডেভিড ফিলোর হাতে পথচলা শুরু ইয়াহুর। স্ট্যাফোর্ডের তড়িৎ প্রকৌশলে স্নাতক ইয়াং ও ফেলো ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরে চালু করেন ‘গাইড টু দ্য ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব’। শুরুর সময় এতে ছিল দুই হাজারের বেশি ওয়েবসাইটের সমন্বয়। ইন্টারনেট হিস্ট্রি ব্রডকাস্টের তথ্য অনুযায়ী, পরের বছরই তা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। আর প্রতিষ্ঠানের নাম সে সময় বদলে রাখা হয় ইয়াহু। শুরুতে ইয়াহুর অফিসিয়াল কার্যক্রম শুরু হয় ক্যালিফোর্নিয়ার সান্টাকারায়।
১৯৯৫ সালে ইয়াহুর সিইও টিম কুগল ক্রমবর্ধমান ইন্টারনেট যুগে নেতৃত্ব পদ নিরাপদ করার প্রচেষ্টার কারণে প্রযুক্তির চেয়ে মিডিয়া কোম্পানি হিসেবেই বেশি পরিচিত হতে থাকে ইয়াহু। গ্রাহক বাড়ানোর ল্েয পেজে যোগ করে শপিং ও ইয়াহু মেইল।
২০০১ সালে ইয়াহুর সিইও পদে যোগ দেয় টেরি সেমেল। তার সময়কালে গুগলের কাছে পরাজয় হয় ইয়াহুর। তবে প্রতিষ্ঠানটিতে মিডিয়ার দৃষ্টিকোণ শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন সেমেল। ২০০২ সালে সেমেল ১০০ কোটি ডলারে গুগল অধিগ্রহণের প্রস্তাব দেয় সার্চ ইঞ্জিনের দুই কর্ণধার ল্যারি পেজ ও সের্গেই ব্রিনকে। কিন্তু গুগল প্রতিষ্ঠাতারা সেমেলের কাছে দাবি করেন ৩০০ কোটি ডলার। ২০০৪ সালে ইয়াহুকে ছাড়িয়ে যায় গুগল। পাশাপাশি গুগলের জনপ্রিয়তাও বাড়তে শুরু করে সার্চ ওয়েব হিসেবে। গুগলেই থেমে ছিলেন না সেমেল। ইউটিউব কেনার চেষ্টা করলেও সফলতা মেলেনি। ২০০৬ সালে প্রায় ১০০ কোটি ডলারে ফেসবুক অধিগ্রহণের প্রস্তাব দেন কর্ণধার মার্ক জুকারবার্গকে। তাকে এক কথায় ‘না’ বলে দেন জুকারবার্গ।
২০০৭ সালে সিইও হিসেবে দায়িত্ব নেয় জেরি ইয়াং। তিনি শুরু থেকেই প্রতিশ্র“তিবদ্ধ ছিলেন প্রযুক্তি উন্নয়নে কাজ করার জন্য। আয় কমে যাওয়ায় ২০০৮ সালের মধ্যেই ছাঁটাই করলেন ১৫ হাজার কর্মী। গুগল ইয়াহুর সঙ্গে বিজ্ঞাপন অংশীদারিত্বের প্রস্তাবনা তার মাথা থেকেই এসেছিল। তবে সরকারের অ্যান্টিট্রাস্ট নিয়ন্ত্রকের হস্তেেপ এ কার্যক্রম সফল হয়নি। ২০০৭ সালে ১ কোটি ২০ লাখ ডলারে মাইক্রোব্লগিং সাইট টুইটার অধিগ্রহণে প্রস্তাব দেন জেরি। কিন্তু তার প্রস্তাব সফল হয়নি। ২০০৮ সালে ইয়াহু অধিগ্রহণে আগ্রহ দেখান সফটওয়্যার জায়ান্ট মাইক্রোসফটের সিইও স্টিভ বালমার। কিন্তু সম্মত ছিলেন না ইয়াহু কতৃপক্ষ।
২০০৯ সালে ক্যারল বার্টজ সিইও হিসেবে যোগদান করেন ইয়াহুতে। বার্টজের শাসনামলে বেশি গুরুত্ব পায় দতা, ব্যয়সঙ্কোচনে কর্মী ছাঁটাই ও মন্দায় থাকা ব্যবসা বন্ধ করে দেয়া। ২০০৯ সালে মাইক্রোসফটের সঙ্গে করা বহু দিনের অংশীদারিত্বে বাদ সাধেন বার্টজ।
২০১২ সালে সিইও হিসেবে স্কট থম্পসনের শাসনামল ছিল মাত্র চার মাসের। ২০১২ সালের শেষ দিকে মারিসা মেয়ার সিইও হিসেবে ইয়াহুর পাল ধরেন। সিলিকন ভ্যালির তারকা মারিসা মেয়ার একসময় ছিলেন গুগল কর্মকর্তা। তাই ম্লান ইয়াহুর ঔজ্জ্বল্য ফিরিয়ে আনতে তার ওপর অগাধ আস্থা রেখেছিলেন বিনিয়োগকারীরা। অনেক অধিগ্রহণ ও নতুন পণ্যে বিনিয়োগ করেও আয় বৃদ্ধিতে তার সফলতা মেলেনি।

0 replies

Leave a Reply

Want to join the discussion?
Feel free to contribute!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *